6/recent/ticker-posts

দেশে মেধাবীদের মূল্যায়ন কবে হবে? --শাহীন কামাল


বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার আজীবন স্বপ্ন লালন করে তীরে পৌঁছানোর আগে স্বপ্নের নায়কদের ভিলেনের মত আচরণে প্রচন্ড  অভিমান করে আত্মহত্যা করে মো. সাইফুর রহমান প্রতীক নামে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি (জিইবি) বিভাগের ২০১১-১২ সেশনের এক মেধাবী শিক্ষার্থী। আমরা সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন ছেলে মারা গেলেই বলি মেধাবী আর মেয়ে হলে বলি সুন্দরী।  প্রতীকের ক্ষেত্রে সেরকম নয়। অনার্সে ফাস্টক্লাস ফাস্ট হওয়াটা ছেলেটিকে মেধাবী না বললে অন্যায় হবে। প্রতীক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চেয়েছিল। এটাই তাঁর অপরাধ।নিজ বিভাগের শিক্ষকদের অনাচারে প্রচন্ড রাগ ও ঘৃণায় এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। প্রতীকের বড় বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের শিক্ষক শান্তা তাওহিদা স্পস্টতই তার ভাইয়ের আত্নহত্যার জন্য জিইবি বিভাগের শিক্ষকদের দায়ী করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।  

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অনাচারে এই অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর ইতিহাস নতুন নয়। ২০১৮ সালের ১৪ মে এরকম আরেক বলি দেবাশীষ মন্ডল। নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চেয়েছিলেন দেবাশীষ মন্ডল। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ( পবিপ্রবি) ২০০৯-১০ সেশনে মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ১ম শ্রেণী পাওয়া থেকেই শিক্ষক হওয়ার অদম্য বাসনা লালন করছিল। চাকরি পাওয়ার সকল পরীক্ষায় ভাল করেও ১৫ লাখ টাকায় রফা হয়েছিল। হয়ত আরো উচ্চ দামে বিক্রি হওয়ায় চাকরিটা না পেয়ে রাগে ক্ষোভে আত্মহত্যা করে ছেলেটি।  নিহতের ভাই সবিস্তারে বলেছিল সেবিষয়ে। পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।  তারপর আর কোন অগ্রগতি হয়েছে বলে শুনিনি। ছেলেটি অবশ্য গবেষণা ক্ষেত্রে তার অসামান্য মেধার স্বাক্ষর রেখেছিল ছাত্রাবস্থায়। সেসকল খবরও পত্রিকায় এসেছিল।                    

ঘটনা দু'টির ভিকটিম আর সম্ভাব্য সন্দেহভাজন একই।  উভয়েই নিজ বিভাগে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে স্বীয় শিক্ষকদের প্রতি অভিমান কিংবা ক্ষোভ প্রকাশ করে আত্নহত্যা করেছিল।  হয়ত সম্মুখ ভবিষ্যত ফলাফল একই হবে। দেবাশীষের ক্ষেত্রে আমরা যেমন কিছুদিন পরই ভুলে গেছি প্রতীকের ক্ষেত্রেও একই ঘটবে। আমরা কোন নতুন শোকে ব্যস্ত হয়ে এদের ভুলে যাব। অপরাধী চিরকাল অধরাই থেকে যাবে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া এদেশের শিক্ষার্থীদের আজীবনের লালায়িত স্বপ্ন। জগত সংসার বুঝে উঠার আগেই একজন শিক্ষার্থীর মনে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন বুনে দেয়া হয়, তা প্রাপ্তির জন্য রাতদিন পরিশ্রম করে ছেলে কিংবা মেয়েটি। কত বাবা মা ছেলেমেয়ের এই স্বপ্ন পূরণে জীবনের ন্যুনতম প্রয়োজনটিকে ছুড়ে ফেলে! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া ছেলেমেয়েদের চোখেমুখে প্রথমে প্রাপ্তির যে ঝিলিক দেখি প্রতিবছর তা অবর্ণনীয়। অথচ সেই স্বপ্নের বাগানে আগাছা জম্মে অল্পকাল পরেই। ভাল ফলাফলের জন্য শিক্ষকদের অপ্রত্যাশিত আচরণের ইতিহাস সর্বজনবিদিত। প্রতীকের ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটেছিল। অনার্স কোর্সে ১ম হলেও শুধুমাত্র তাকে আটকানোর জন্য মাস্টার্সে সুপারভাইজার দেয়া হয়নি। শেষে কিনা ছেলেটি আত্মহত্যা করে প্রতিবাদ করল।

আত্মহত্যা কোন প্রতিবাদের ভাষা হতে পারেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছেলে বা মেয়েকে এ সত্য উপলব্ধি করে প্রতিবাদের ভিন্ন পন্থা খুজে নিতে হবে। যে বা যারা এমন অনাচার করে, তাদের সাথে কিসের অভিমান! বরং বেঁচে থেকে দেখিয়ে দেয়া জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাই জীবনের একমাত্র লক্ষ হবে কেন? যাদের মেধা আছে, তাদের জন্য রয়েছে হাজারো পথ। আর সম্মান!! যারা এহেন কর্ম করতে পারে, সেই চেয়ারে বসার চেয়ে বিকল্প পথ খোঁজা অনেক শ্রেয়। জীবনে লক্ষের ক্ষেত্রে অবিচল থাকার মানে এই নয় যে, ব্যর্থ হলে জীবন দিতে হবে। এখানে একজন যা পাবে বা দিতে পারবে, হয়ত অনেক বেশি অপেক্ষা করছে তার জন্য অন্য ক্ষেত্রে। প্রতিবাদ হোক বীরের মত, কাপুরুষতা দেখিয়ে নয়।    
             
প্রতীকের আত্মহত্যার প্ররোচনায় বিচার চাই না।শুধু এধরনের অনাকাঙ্খিত মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হোক।  যারা জাতিকে পথ দেখান, তাদের পথহারানো অশনিসংকেত। আর যেন এধরনের সংবাদ গণমাধ্যমের খোরাকে পরিনত না হয়।  দেবাশীষ, প্রতীকরা যেন স্বীয় মেধায় সামনে এগিয়ে জাতিকে পথ দেখাতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন হয় মেধা, মনন বিকাশ আর মূল্যায়নের সত্যিকারের ক্ষেত্র। প্রতিযোগিতা হোক মেধার সাথে মেধার। কোন রঙ যেন জাতির আশা আকাংখার শেষ আশ্রয়কে কালিমা দিতে না পারে।                

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞানের বাতিঘর।  এক একটা বিশ্ববিদ্যালয় এক একটা আলোকবর্তিকা।  শিক্ষাদীক্ষায়, গবেষণায়, জ্ঞানদানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বমহিমায় ভাস্কর।  সেখানে যদি স্বপ্নভংগের এমন হিংস্র উপলক্ষ থাকে, তবে জাতির দুর্ভাগ্য। আমাদের জাতীয় জীবনের সকল প্রয়োজনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুমিকা অনস্বীকার্য। জাতিকে সঠিকপথে পরিচালিত করতে প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প কোথায়! সেখানে যদি একজন শিক্ষার্থীর এমন করুণ পরিণতি হয়, তবে তো ভাববার বিষয়।      

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হোক সত্যিকারের মেধাবীদের অভয়ারন্য। দেশের সকল মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের ভিন্ন চোখে দেখতে চায়।সামান্য ধান্দায় তাদের তেলবাজি মানুষের চোখে বাজে। নিয়োগ বানিজ্যের অভিযোগ তাদের সম্মানহানী করে। ব্যক্তিস্বার্থে দলবাজি তাদের মানায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে সেরাদের সেরা বাছাই করতে সঠিক মূল্যায়ন খুবই জরুরি। তা না হলে প্রতীকের মত কেউ কেউ অপ্রত্যাশিত প্রতিবাদ করে পুরো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিবে, যা কারো কাম্য নয়।

--
কামাল হোসেন শাহীন
লেখক, শিক্ষক,  সাংবাদিক।

Post a Comment

0 Comments