6/recent/ticker-posts

প্রিয়জন হারানোর হাহাকার


মোঃ কামাল হোসেন শাহীন ॥
মুনকে নিজ হাতে গোছল করালেন নাজিম। স্ত্রী আর নবাগতা কন্যা  হাসপাতালে। তিনদিন আগে সিজারিয়ান অপারেশনে নূরকে কোলে পেয়েছে। মুনকে বললেন, " তোমাকে আর আমি গোছল করাতে পারব না। আজই শেষ। এরপর নিজে নিজে গোছল করবে।" কে জানে সেই কথাই সত্যি হবে! মেয়ের কেন এর উত্তরে বলেছিল, " আমাদের আরেকটা বাবু আছে না!! তাকে সময় দিতে হবে। তুমি বড় হয়েছ না!"



মুন কতটুকুই বড় হয়েছে! লঞ্চে করে বাবার কফিন আনার সময়ও খেয়াল করেনি, বাবাকে চিরদিনের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। সারারাত নানার ফোনে বাবাকে খুঁজে আর বলে,  আমাকে রেখে একা একা দাদা বাড়ি আগেই চলে গেছে। এবার বকা দেব! দিন যতই পেরুচ্ছে,  বাবা হারানোর যন্ত্রণা তাকে ততই আড়ষ্ট করছে। ছোট্ট মুন বুঝতে শুরু করছে, তার বাবা আর ফিরছে না। আত্মীয়স্বজনের কাছে মুনের এ হাহাকারের কোন উত্তর নেই।

বাবা ছাড়া মুন খেতে পারে না। খাবার টেবিলে বাবাকে না পেলে ফোন দেয়। বাবা যদি বলে, আমি বাইরে খেয়েছি। তবে বলে, ছবি পাঠাও। ছবি দেখে নিশ্চিত হয়েই তবে খেত মুন। নানা আর খালু একদিকে সেই কথা বলে বিলাপ করছেন  অন্যদিকে মুনের বৃদ্ধ দাদা দাদুর করুণ আর্তনাদ আগন্তুক আত্মীয়স্বজন আর প্রতিবেশীকে বেদনায় পূর্ণ করে। বাইরে তখন বৃষ্টিস্নাত মাটিতে নাজিমের বিদায়ের সব ব্যবস্থা চুড়ান্ত।

আলহাজ্ব আনিচল হক ও মিসেস আনিচল হক দম্পতির চার মেয়ের পর প্রথম ছেলে। অনেক বেশি আদর যত্নে বড় হয় নাজিম। নিজে লেখাপড়া করে ভাইদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে। ছোট দুই ভাই যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী হওয়ার পিতামাতা আত্মীয়স্বজনের মধ্যমণি হয়ে উঠে নাজিম। বাড়ির দরজায় মসজিদ নির্মান আর সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ তাকে মানুষের মনে এক অনন্য উচ্চতায় স্থান দেয়।

প্রতিদিনের মত মোটরসাইকেলে অফিসে যাচ্ছিল নাজিম। বেপরোয়া দুই গাড়ির অযাচিত প্রতিযোগিতার অপ্রত্যাশিত পরিণতিতে চাকায় পৃষ্ট হয়ে ক্ষয়ে পরে এক সম্ভাবনাময় সমাজকর্মীর সম্মুখ জীবন। প্রচুর রক্তক্ষরণে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছানোর আগে শত বাঁধন ছিন্ন করে চিরকালের জন্য পাড়ি দেয় অনন্তকালে পথে। হাজারো হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আর কান্নার লোনাজলেও সে যাত্রা ব্যাহত হয় না। বিধির অমোঘ নিয়মেই বাস্তবায়িত হয়।

নাজিমের লাশ নিয়ে বন্ধু আর আত্মীয়রা যখন ঢাকা মেডিকেলে মাতম করছে, স্ত্রী আইরিন তখনও হাসপাতালে। কিভাবে তাকে এ সংবাদ দেবে, তা নিয়ে ভাববার অন্ত নেই। তাকে শ্যামপুরে বাবার বাসায় আনা হয়। তখনও সে জানেনা, তার জীবনে কী দুঃসংবাদই না অপেক্ষা করছে! লাশ দেখে তার গগনবিদারী চিৎকার কঠিন পাষন্ডেরও চোখে অশ্রুঝরা বন্ধ করতে পারেনি। প্রচন্ড অসুস্থতার মাঝে প্রাণপ্রিয় স্বামীর কপালে শেষবারের মত হাত দিয়ে বিদায়কালে তার সুস্থতা নিয়ে স্বজনকে ভাবিয়ে তুলেছে। হাসপাতালের পাঠানোর সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে নবাগত শিশুর অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে আইরিনের কান্না, এক শোকাবহ পরিবেশ তৈরি করে।

ঘাতক বাসের চালকদের আটক করা হয়েছে। জব্দ হয়েছে বাস দুটি। পুলিশ মামলাও করেছে। কিন্তু ন্যায়বিচার প্রাপ্তির প্রত্যশায় সন্দেহ থেকে যায়। অতীত ইতিহাস ইতিবাচক নয়। আইনের ছোট ছোট ফাঁকফোকর দিয়ে এমন বড় বড় অপরাধীর বের হয়ে যাওয়া আমাদের শংকায় ফেলে দেয়। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে,  ধরা পরার পরেও অপরাধীরা অবিচল ছিল। আসামীদের এই নির্লিপ্ততা ভাবিয়ে তুলছে আমাদের। আসামীদের এ উদাসীনতার দুইটা কারন হতে পারে, যাদের উভয়টিই আমাদের স্বাভাবিক চলাফেরার অন্তরায়। প্রথমত,  তারা মনে করতে পারে এ হত্যায় তাদের কিছুই হবে না। দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান শক্তি অচিরেই তাদের মুক্ত করে দিবে। অন্যদিকে নির্লিপ্ততার অন্য কারন হতে পারে মাদক যা স্বাভাবিক চিন্তা চেতনাকে পঙ্গু করে রেখেছে। তাই যদি হয়, তবে এই উম্মাদ অবিবেচকদের কাছে আমরা কেউই নিরাপদ নই।

বাস শ্রমিকদের রয়েছে শক্তিশালী সংগঠন।  তাদের হাত এত লম্বা যে তা ক্ষমতার শক্তিশালী অংশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাদের পক্ষে কথা বলার এমপি মন্ত্রী আছে।  তাইতো তারা বহু অন্যায়ের পরেও টিকে থাকে বহালতবিয়তে। যাত্রীদের কোন সংগঠন নেই, ফোরাম নেই।

চালকদের অবশ্যই আইনের আওতাধীন রাখতে হবে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কল্যাণকামী রাষ্ট্র নাগরিকদের এ মৌলিক অধিকারকে অবশ্যই বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। চালকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তারা শুধু গরু ছাগল চিনলেই হবে না, মানুষ চিনতে হবে। মাদক বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারনা থাকতে হবে। কোন মাদকাসক্তের হাতে এত এত জানমাল তুলে দিবে না রাষ্ট্র, তা সচেতনভাবেই নিশ্চিত করতে হবে।
ঘাতক চালকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। নাজিমের মত অন্য কেউর এ নির্মম পরিণতি যেন না হয়। মুন আর নূরের মত শিশুরা যেন আর পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত না হয়। বিচারের দাবী জোরালো হোক। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে এ চাওয়া কিন্তু খুব বেশি নয়।

লেখক:মোঃ কামাল হোসেন শাহীন
সমাজ কর্মী, শিক্ষক।
২০এপ্রিল ২০১৮
ভোলা



Post a Comment

0 Comments