6/recent/ticker-posts

সাজেকঃ যেখানে আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায়


ভোরের আলো আঁধারে ঘুম ভাঙ্গে পাহাড়ি পথের এবড়োথেবড়ো চলার অভিজ্ঞতায়। ভেবেছিলাম এই বুঝি এসে গেছি গন্তব্যে।  এর পরেও চলে গাড়ি।  কখনো উপরে উঠতে উঠতে আবার নেমে যায়। কিছুটা ভয়ও কাজ করছিল। দোকানের সাইনবোর্ড দেখে নিশ্চিত হই, এখনো বেশ  বাকী আছে গন্তব্য।

খাগড়াছড়ি যখন আমাদের গাড়ি থামে, তখন সকাল প্রায় আটটা। মানুষজনের সিংহভাগই যে পর্যটক তা তাদের চলনে বলনে নিশ্চিত করে। আমাদের টিএম( ট্যুর ম্যনেজার) জানায় আমাদের জন্য হোটেল রেডি আছে। তবে আমরা যতদ্রুত সাজেক পৌঁছুতে পারি ততই ভাল। প্রস্তাব আসে, তাহলে আর সময়ক্ষেপন কেন? যেই কথা, সেই কাজ। সকালের নাস্তা শেষ করে যাত্রা করি মেঘের দেশে।

চান্দের গাড়িতে আমরা চারজনসহ মোট সাতজন।  সাথের বাকি তিনজন অল্প বয়স্ক ছেলে। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে দেশ দেখতে বের হয়েছে। খাগড়াছড়ি শহর পেরুলেই গ্রামীণ জনপথ। একটিমাত্র রাস্তা আমাদের নিয়ে যাচ্ছে লোকালয় থেকে লোকজনহীন পাহাড়ি বন্ধুর পথে। গাড়ি চলছে উল্কার বেগে। শুধু একটি, দুটি নয়। সারি সারি গাড়ি যাচ্ছে একই পথে। রাস্তার দুপাশে এলোমেলো পাহাড়ি ঘর। ঘরের সামনে কোন পাহাড়ি বধু আপন মনে লম্বা বাশঁ দিয়ে তৈরি হুক্কা টানছে আপন মনে। যেন এক বিরাট দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত তারা। পোশাক পরিচ্ছেদে সেই ছোটবেলা বইয়ের পাতায় দেখা পাহাড়িদের চিরচেনা রুপ। পুরুষদের খুব একটা চোখে পড়েনি। পরে শুনেছি তারা জুম কাটায় ব্যস্ত। সময় যত গড়ায় বাঙ্গালীর সংখ্যা ততই কমতে কমতে শূন্যে পৌঁছে। রাস্তার পাশে, ঘরের কোনে শিশুরা হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে। এই আদিবাসী শিশুরা সকাল থেকেই অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কাজটি করে যাচ্ছে। পর্যটকদের কেউ কেউ আবেগ দেখিয়ে চকলেট ছুঁড়ে মারে। অবশ্য এতে চকলেট নিতে গিয়ে বড় রকমের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থেকে যায়। এখানে ড্রাইভারদের গাড়ি চালাতে দেখে যেকেউ ভয়ে শিউরে উঠবে।দেখেশুনে মনে হয়েছে এই পাহাড়ি আকাঁবাঁকা পথে এমন গতিতে গাড়ি না চালিয়ে খুব একটা বিকল্পও নাই। কারণ দ্রুত গতিতে এই উপরে উঠছে তো পরক্ষণেই নেমে যাচ্ছে নিচে। পুরো পথটাকে মনে হয়েছে এক রোলার কোষ্টার অভিজ্ঞতা। যতটুকু নামছে উঠছে তার দ্বিগুনেরও বেশি। স্পষ্টতই টের পাচ্ছি আমরা উপর থেকে আরো উপরে উঠছি,অনেক উপরে।যেনতেন উপরে নয়, আমাদেরকে যে ১৮০০ ফুট উপরে উঠতে হবে।

খাগড়াছড়ি থেকে ২১ কি মি পেরুলে দিঘীনালা  থানা। এই দিঘীনালা হয়েই যেতে হয় সাজেক। একটি থানা সদরের প্রয়োজনীয় সকল অফিস আদালত আছে সত্য কিন্তু আধুনিকতার অভাব বেশ লক্ষনীয়। অল্পস্বল্প লোকজনের আনাগোনা আর পাহাড়ী অঞ্চলের সমতল ভুমির স্বল্পতা শহরটিকে কিছুটা হলেও সংকুচিত করে রেখেছে। আমাদের আরো যেতে হবে ৫৯ কিমি যেখানে দেশের মানচিত্র শেষ হয়ে জানান দিচ্ছে অন্য আরেক দেশ।

বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর আমাদের বলা হয়, আমাদের গাড়ি পাহারা দিয়ে নেয়া হবে। সব গাড়ি একত্রিত হলেই আবার যাত্রা শুরু হয়। পথিমধ্যে গাড়ি থেকে নেমে তালিকা দিতে হয় বিজিবির কাছে। অনুমতি নিতে হয় সাজেকে ঢোকার। 

আমরা যখন মুগ্ধ হয়ে দুই পাশের প্রকৃতির সৌন্দর্য নিংড়ে নিংড়ে হৃদয়ে ধারণ করছিলাম, ঠিক তখনই হঠাৎ গাড়ির গতি থেমে যায়। সামনে তাকিয়ে খেয়াল করতেই দেখি লম্বা গাড়ির সারি, সকল গাড়ি থেমে আছে। ড্রাইভারের সহযোগী ছেলেটা বলে উঠে ঝর্ণা এসে গেছি।  আমরা সবাই হুড়মুড় করে নেমে পরি। সূর্য যেন আজ সবটুকু তীব্রতা নিয়ে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। আমরা সবাই ঘেমে ঝর্নায় গোছলের মতই ভিজে একাকার।কালবিলম্ব না করে পরনের পোশাক পরিবর্তন করে নেমে পরি পাহাড়ি পথে। বেশ অনেকটা পথ হেঁটে পাহাড়ের  পাদদেশে নামলেই হাজাছড়া ঝর্ণা।  বেশ উঁচু থেকে পাহাড়ের বুক চিড়ে নেমে আসছে পানির স্রোতধারা। বহু উপর থেকে নেমে আসা পরিস্কার জলরাশিতে হাত পা ভিজিয়ে কেউ আবার পুরো শরীর ভিজিয়ে এক অনন্য আনন্দে আন্দোলিত হচ্ছে।  ফেরার পথে পাহাড়ের বাঁকে, রাস্তার পাশে বেশ কয়েকটি টঙ দোকান।গরমের মাঝে একটু স্বস্তি ও জিরিয়ে নেয়ার জন্য  দোকানগুলো হচ্ছে চমৎকার বিশ্রামাগার।পাহাড়ি বাচ্চাদের খাবার বিক্রি করার আহবানও বেশ দারুন,সেই আহবানে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। পাহাড়ের আনাচে কানাচে কী পরিমাণ কলা চাষ হচ্ছে, তা সাজেক যেতে যেতে রাস্তার দুই পাশের বাজারগুলোতে কলার স্তুপ দেখে সহজেই অনুমান করা যায়।গাছ থেকে সদ্য নিয়ে আসা পাঁকা পেপে যেন অমৃত। ডাবের পানিও ঝর্নার জলের মত তৃষ্ণা মেটায়। সকল দোকানদারই মহিলা। দামের ব্যপারে তারা দেশের অন্য পর্যটন স্পটের মতই বেশ পরিপক্ষ।

বিরতি শেষে আবার যাত্রা শুরু হয়। খাগড়াছড়ি থেকে শুরু হওয়া রাস্তা সাপের মত আঁকাবাঁকা হয়ে চলছে তো চলছেই। পুরো পথে কোন শাখা রাস্তা চোখে পড়েনি। প্রায় জনমানবশুণ্য রাস্তায় গাড়ি চলছে। কখনো উপরে আবার পরক্ষণেই নিচে নেমে যাচ্ছি।

এভাবেই শ্বাসরুদ্ধকর আঁকাবাঁকা পথে চলতে চলতেই একপর্যায়ে আমরা বেশ বুঝতে পারি গাড়ি উঠছে তো উঠছেই। একটু পরেই আবিষ্কার করি আমরা পৌঁছে গেছি। রুইলুই পাড়া, সাজেকে আসা পর্যটকদের গন্তব্য। এখানে আসা প্রায় সকল পর্যটক এখানেই থাকে। বিকেলবেলা পাহাড়ি পথে  তিন কিমি হেঁটে চলে যায় কংলাক পাহাড়ে। এটাই বাংলাদেশের শেষ সিমানা এবং এ অঞ্চলের সবচেয়ে উচু পর্বত। কংলাকে যাওয়া এবং থাকা বেশ ঝুঁকিপূ্র্ণ কারণ রুইলুইর পর কোন বিজিবি ক্যাম্প না থাকায় অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে প্রায়ই অনুমতি দেয়া হয় না। আমাদের  থাকার ব্যবস্থা হয় সেই কংলাক পাহাড়েই। 
চলবে....
--
লেখক:কামাল হোসেন শাহীন
প্রভাষক,নাজিউর রহমান কলেজ,ভোলা।

Post a Comment

0 Comments