6/recent/ticker-posts

আমারও একদিন বাড়ি ছিল -শাহীন কামাল


আমারও একদিন বাড়ি ছিল। উঠানের চারপাশের অনেকগুলো ঘরের কতজনের সাথে হেসে খেলে বড় হয়েছি। বাড়ির দরজার কাচারি ঘর, পুকুরপাড়, খালপাড়, বিলে হৈচৈ করে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতাম। নিত্যদিনের মত রাগারাগি,  ভয় দেখানো - আজ বাড়িতে আসুক ইত্যাদি ইত্যাদি। শীতের এই পরন্ত বিকালে কোনরকমের পানি ছুয়ে ঘরে ফেরা। ভারী কাপড় গায়ে দেয়ার কথা বলে ভাপা পিঠা আর বাটিতে করে ঘন রস দিয়ে বলতেন" খেয়ে পড়তে ব"। পড়ার নামে ফাঁকিবাজি শুরু করার অল্প পরেই হাই তুলে রাজ্যের ঘুম নামত চোখে।  হারিকেনের হালকা আলোয় বইর উপর মাথা ঠেকে ঘুমিয়ে পরেছি কত দিন! ' কই পরছ না' শব্দে লাফিয়ে উঠে আআআ শুরু করেছি।  কি পড়েছিলাম, তখনও বুঝিনি।  মাথায় থাকত কখন খেতে ডাকবে। রাতে খাওয়া মানে ঘুমিয়ে পরার অনুমোদন। ঘুমাতে ঘুমাতে রাতের খাবার। আব্বা বলতেন, মুরকা হাঁসেও ঘুমায়নি এখনও।

ভোরটা শুরু হত কাকডাকা ভোরে।  পৃথিবীতে সকালে ঘুমের চেয়ে প্রিয় কিছু আমার কাছে ছিলনা, এখনও নেই।  আমাকে ঘুমাতে দিতেন না। 'সৃর্য উঠল, নামাজের সময় শেষ' বলেই ঘুম থেকে তুলে দিতেন।  শুধু এই সময় নয়, আজীবনই এই কাজ করেছেন।  মারা যাওয়ার আগে ফজরের সময় ফোন দিতেন। বোনকে বলে গেছেন,  যতদিন বাঁচবেন,  আমাকে ফোন করে জাগাবেন। আমাকে ভোরে জাগাতে বেশি দিন পারলেন না। নিজে না পারলে বোনদের লাগিয়ে দিতেন। পরবর্তীতে ভাইগ্না, ভাগ্নীদের।

আমার বেশি দিন বাড়ি থাকা হল না।  আব্বা আমাকে উচ্চ শিক্ষার্থে একদিন বিদেশ(!) দিয়ে আসেন। ১০/ ১১ বছরের একটি ছেলের কাছে হোস্টেলে থাকা আর বিদেশে থাকার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। বাড়ি ফেরার কি টান ছিল তখন! কারনে, অকারণে , ছুটিতে, নানা অজুহাতে বাড়ি ফিরতাম। শুধুমাত্র একরাত বাড়িতে থাকার জন্য দীর্ঘপথ পায়ে হেটেছি।  কখনও প্রচন্ড বর্ষায় কাদামাটিতে কিংবা চৈত্রের কাঠফাটা রোদে পুড়ে। বাড়ির টান আর বাড়িতে যে আছে তার টানে কত পথ পাড়ি দিয়েছি!

বোনদের উচ্চ শিক্ষা আর আমাকে নিজেদের কাছে রাখার জন্য একদিন আমাদের ঘরের সমূদয় মালামাল নিয়ে আমরা চলে আসি নতুন ঠিকানায়। ঘরটিকেও নিয়ে আসি। সেদিন বাড়ির সকল মহিলারা আম্মাকে ধরে কি কান্নাকাটি করেছিল! তাদের সে কান্না দেখিছি মাস দুয়েক আগে। ঘর ভিটা আজও অনাদরে।  অথচ কত যত্ন করে আম্মা তাকে সাজিয়ে রাখতেন পরম মমতায়। আজ আম্মা নেই, ঘর ভিটায় আগাছা বসত করেছে, পরম নির্ভরতায়।যেন কেউর কিছু বলার নেই।       

নতুন ঠিকানাকে বাসা বলা হলেও আমার কাছে বাড়িই ছিল।  পেছনে পুকুরে মাছ, সামনের খোলা জায়গা আর নানাবিধ ফলের সম্ভার বেশ গ্রাম্য আবহ ছিল। পড়শীদের কেউ কেউ আমাদের মত নতুন আগন্তক হওয়ায় ভিন্ন সমাজ তৈরি হয়।  স্থানীয়দের সাথেও আত্মীক সম্পর্ক ছিল অসাধারণ। পুরোনো ঠিকানায় নিত্য যোগাযোগ আর কেয়ারটেকারের কারনে গ্রামের সবই ছিল আমাদের। শহরের উপকন্ঠে আমাদের সেই বাসাও একদিন বাড়িতে পরিনত হয়।

বাড়ি আমায় বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি।  তবে সপ্তাহে, মাসে বাড়ি আর মায়ের টানে নিত্য বাড়ি যাতায়াত। বাড়িঘর আমায় অক্টোপাসের মত জড়িয়ে রাখে। এই পথঘাট, লোকজন আর লোকালয় আমার আত্মীয় হয়ে উঠে। আমার হারানো শৈশবের আলো ছড়িয়ে নতুন বাড়িও হয়ে উঠে মনোজগতের শেষ আশ্রয়স্থল।

ধীরে ধীরে জাগতিক প্রয়োজনে নিজেই বাড়ি ছেড়ে ইটপাথরের চারদেয়ালে বাধা পরি। দায়িত্ব আর প্রয়োজনে পুরনো পথে ধুলা পরে। আম্মাকে কতবার বলি, থেকে যাননা।  তার থাকা হয়না। নিজের ভুবন ছেড়ে চারদেয়ালে আটকানো জীবন তার বন্দী সমান।  আমার আর আম্মার সাথে থাকা হয়ে উঠে না।     

আম্মার কবরের পাশে বেশ খানিকটা জায়গা আছে। অন্তত আরো ৫ জন থাকতে পারবে। যদি সুযোগ আসে আমরাও একদিন আম্মার সাথে পাশাপাশি থাকব। ইতিকে একদিন জায়গাটা দেখালে ও বলে, আর কে কে? বলি, আমি, তুমি আর আব্বাতো আছে!! ও কিছু বলে না।  অপলক চেয়ে থাকে জায়গাটির দিকে। আমিও...

--
লেখক:কামাল হোসেন শাহীন
প্রভাষক,নাজিউর রহমান কলেজ,ভোলা।

Post a Comment

0 Comments